তিনবার বিসিএস পাস করেও পুলিশের প্রতিবেদন আটকে দিল সাইদুলের স্বপ্ন

মো. সাইদুল ইসলাম একজন প্রতিভাবান তরুণ, যিনি পরপর তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু প্রতিবারই পুলিশ ভেরিফিকেশনের নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে চাকরিতে যোগদানের স্বপ্ন ভেঙে যায়। সাইদুলের নিজের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলেও, তাঁর বাবা ও ভাইয়ের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণেই তাঁকে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

পুলিশের নেতিবাচক প্রতিবেদন: এক বিসিএসের পর আরেক বিসিএস হারানো

সাইদুল ইসলাম ৩৮তম, ৩৯তম বিশেষ ও ৪০তম বিসিএসে পাস করেন এবং তিনবারই সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) থেকে সুপারিশ পান। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের সহকারী সার্জন পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পেয়ে তিনি নিজেকে নিশ্চিত ভাবছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গেজেটে নিজের নাম দেখতে না পেয়ে ভেঙে পড়েন তিনি।

সাইদুল বলেন, “রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চার বছর শুধু বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছি। এত কষ্টের পরও নিজের নাম গেজেটে না দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই।”

থানায় যোগাযোগ করলে জানানো হয় যে তাঁর নামে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু বাবার বিরোধী দলীয় রাজনীতির কারণে তাঁর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। রংপুর জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তখনকার পুলিশ সুপার তাঁকে সাফ জানিয়ে দেন, “বিরোধী দলের সভাপতির ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে না।”

অন্য চাকরির পরামর্শ ও হতাশা

সাইদুলের প্রথমবারের গেজেটে নাম না আসার পর দ্বিতীয়বারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তিনি পুলিশ সুপারের কাছে আবার গেলে, তাঁকে বেসরকারি চাকরি খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং বলা হয়, তাঁর সরকারি চাকরি হবে না। এরপর সাইদুল হতাশ হয়ে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন। কিন্তু সেখান থেকেও একই প্রতিক্রিয়া পান—সাইদুলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলেও তাঁর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়েছে।

কোর্টে রিট ও নিয়োগের লড়াই

২০২০ সালে সাইদুলসহ ৩৮ জন বাদ পড়া প্রার্থী হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত তাঁদের নিয়োগের আদেশ দিলেও, রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে আদেশ স্থগিত করে। এ সময় সাইদুলের পরিবারের জন্য মানসিক কষ্ট ছিল প্রচণ্ড। তাঁর বাবা বারবার নিজের রাজনীতি করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন। বাবার কান্না দেখার স্মৃতি সাইদুলের জন্য ছিল সবচেয়ে বেদনাদায়ক।

তিনি বলেন, “এটা যে কী ধরনের ট্রমা, সেটা শুধু বোঝে যার পরিবারের ওপর দিয়ে যায়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে একজন প্রার্থীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করার অধিকার কারও নেই।”

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান

তবে, অনেক অপেক্ষার পর ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট ২৫৯ জন প্রার্থীকে নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, যাঁরা পুলিশের নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে গেজেট থেকে বাদ পড়েছিলেন। অবশেষে, ১ সেপ্টেম্বর সাইদুল নিজ জেলা পীরগাছায় সহকারী সার্জন হিসেবে যোগ দেন। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান তাঁর জীবনে নতুন আশার সঞ্চার করে।

সাইদুল বলেন, “এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অপেক্ষা ও বৈষম্যের অবসান হয়। অবশেষে আমার নিজের যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পেয়েছি, যা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল।”

পরিশেষে বলা যায়, সাইদুল ইসলামের মতো অনেক প্রতিভাবান মানুষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে বাধ্য হন। এ ধরনের বৈষম্য প্রার্থীদের জীবনে শুধু হতাশাই এনে দেয় না, বরং তাঁদের পরিবারেও গভীর প্রভাব ফেলে। সাইদুলের গল্পটি শুধু একজন ব্যক্তির নয়; এটি দেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের জটিল সম্পর্কের একটি উদাহরণ, যা অনেককেই হতাশ করেছে। তবে সাইদুলের এই নিয়োগে তাঁর জীবনের লড়াই অবশেষে একটি ইতিবাচক পরিণতি পেয়েছে।

আরও পড়ুন: শ্রমিক অসন্তোষ | সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে ১১৪টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top